টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
আপনি কি টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী? এই আর্টিকেলটি টিয়া পাখির যাবতীয় বিষয় নিয়ে লিখা। আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়লে আপনি টিয়া পাখির শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে টিয়া পাখির স্বভাব, খাবার, বাসস্থান এবং প্রজনন সহ সমস্ত বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারবেন।
টিয়া পাখি লালন করতে হলে এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা আবশ্যক। কারণ সঠিক ধারণা না থাকলে আপনার অতি সখের পাখিটির ক্ষতি হতে পারে। তাই একটু সময় দিয়ে টিয়া পাখি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিন।
ভূমিকা
টিয়া পাখি যেন সকল পাখি প্রেমীদের মাঝে একটি ভালো লাগার নাম। আমাদের ব্যস্ত জীবনে একটি সুন্দর টিয়া পাখি ভালো সময় কাটানোর সঙ্গী হতে পারে। যেকোনো ধরনের পাখি পালনের জন্য সর্বপ্রথম এর সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কারণ একটি পাখি সম্পর্কে সমস্ত কিছু না জানলে আপনি এটির পরিচর্যা করে ভালো রাখতে পারবেন না। ঠিক তেমনি টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে আপনি ঠিকমতো এটির যত্ন নিয়ে লালন পালন করতে পারবেন না, যার ফলে আপনার আনন্দের সঙ্গী পাখিটি অসুস্থ হয়ে আপনার মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আপনারও যদি প্রথম পছন্দ টিয়া পাখি হয়ে থাকে, তাহলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ে টিয়া পাখির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, খাবার, বাসস্থান, স্বভাব ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা লাভ করুন বিস্তারিতভাবে।
টিয়া পাখি কত প্রকার
জীববিজ্ঞানীদের মতে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাসরত এই পাখিটির ৩৭২ এর কাছাকাছি প্রজাতি রয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির টিয়া পাখি থাকলেও বাংলাদেশে সাধারণত ৬ ধরনের টিয়া পাখি দেখা যায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক টিয়া পাখির সাধারন কিছু বৈশিষ্ট্যের সাথে এর প্রকারভেদ।
টিয়া পাখির শারীরিক গঠন
টিয়া পাখির প্রজাতিভেদে এবং লিঙ্গভেদে শারীরিক গঠন ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। চলুন জেনে নেওয়া যাক টিয়া পাখির শারীরিক গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত।
বাসন্তী লটকন টিয়াঃ এদের মাথা সহ সমস্ত দেহ সবুজ রঙের এবং ঠোট লাল রঙের হয়। গলার গাড় সবুজ রং পুরুষ এবং স্ত্রী টিয়াকে চিনতে সাহায্য করে। পুরুষ টিয়া পাখির গলার সবুজ রং বেশি গাঢ় হয়ে থাকে। অন্যান্য প্রজাতির টিয়া পাখির তুলনায় এদের আকার ছোট হয়। সর্বোচ্চ ১৪ সেন্টিমিটার আকারের এই পাখিটির ডানা ৯.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১.২ সেন্টিমিটার, দুইটি ছোট আকারের পা ১.১ এবং লেজ ৪.২ সেন্টিমিটার মতো হয়ে থাকে।
সবুজ টিয়াঃ এই প্রজাতির টিয়া অত্যন্ত সুদর্শন হয়ে থাকে। এদের শরীরের অংশ কলাপাতার মত সবুজ এবং লেজের অংশ তুলনামূলক গাড় সবুজ হয়ে থাকে। এদের আকার বাসন্তী লটকন টিয়ার তুলনায় প্রায় তিন গুণ হয়ে থাকে অর্থাৎ ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার। একটি স্বাভাবিক সবুজ টিয়ার ওজন প্রায় ১২০-১৩০ গ্রাম। এদের গলার রং পুরুষ টিয়া থেকে স্ত্রী টিয়াকে আলাদা করে। পুরুষ টিয়ার গলায় এবং থুতনিতে কালো দাগ থাকে। পুরুষ টি আর ঘাড়ে হালকা গোলাপি রং এর আবরণ থাকলেও স্ত্রী টিয়ার ঘাড়ে হালকা সবুজ রং বিদ্যমান।
ফুলমাথা টিয়াঃ এই প্রজাতির টিয়ার আকার সবুজ টিয়ার তুলনায় কিছুটা কম। এদের শরীরের গড় দৈর্ঘ্য হয় ৩৫-৩৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির টির দেহ সবুজ হলেও মাথার রং গোলাপী হয়ে থাকে। সবুজ টিয়ার মতো এদের গলায়ও কালো দাগ রয়েছে। তবে স্ত্রী প্রজাতির ক্ষেত্রে মাথার রং নীল আবরণ যুক্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই চোখের রং হলুদ হয়।
লালমাথা টিয়াঃ এই প্রজাতির টিয়া গুলোর আকার ফুলমাথা টিয়ার প্রায় সমান হয়ে থাকে (৩৫-৩৬ সেন্টিমিটার)। পুরুষ প্রজাতির পাখির মাথা কারো গোলাপী এবং বেগুনি রঙের সমন্বয়ের। এদের লেজের সমস্ত অংশ নীল রংয়ের হলেও শেষের অংশ সাদা। দেহের দিকে তাকালে মনে হয় সবুজের উপর হলুদের আবরণ। এদের ডানাতে থাকা খয়রি রং এবং মাথার রং স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। পুরুষ পাখির ডানার শুরুতে সামান্য খয়েরির রং থাকলেও স্ত্রী পাখির ডানাতে কোন খয়রি রং থাকে না। আবার অপরদিকে স্ত্রী পাখির মাথার রং ধূসর গোলাপী হয়ে থাকে। পুরুষ প্রজাতির পাখির ওপরের ঠোঁটের রং কমলা হলুদ হলেও স্ত্রী প্রজাতির পাখির ঠোঁটের রং হলুদ হয়। নিচের ঠোঁট উভয় ক্ষেত্রেই কালো রঙের হয়।
চন্দনা টিয়াঃ সকল প্রজাতির টিয়া গুলোর মধ্যে চন্দনা টিয়ার আকার সবচেয়ে বড় হয়। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫-৬০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। আগের প্রজাতি গুলোর মতই পুরুষ এবং স্ত্রীদের মধ্যে কিছু সাধারণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ প্রজাতির পাখিদের ঘাড়ের ওপর হালকা গোলাপি আবরণ দেখা গেলেও স্ত্রী প্রজাতির পাখিদের ঘাড়ে এটি লক্ষ্য করা যায় না। উভয় লিঙ্গের প্রাণীর ঠোঁট গাড় লাল এবং ভোটের আগাতে হালকা কমলার ছোঁয় বিদ্যমান।
মদন টিয়াঃ মদন টিয়ার আকার এবং ওজনের ক্ষেত্রে সবুজ টিয়ার সাথে মিল রয়েছে। এদের দৈর্ঘ্য বরাবর আকার হয় প্রায় ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন হয়ে থাকে ১২০-১৩০ গ্রাম। এদের মাথার রং ধূসর বর্ণের এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে উপরের ঠোঁটের রং কালচে লাল এবং নিচের ঠোঁট কালচে বাদামী। স্ত্রী পাখিদের ক্ষেত্রে উভয় ঠোঁটের রং কালো। লালমাথা টিয়ার প্রজাতির মত এদের লেজও নীল-সবুজ রঙের হয়ে থাকে কিন্তু আগার অংশ হলুদ।
টিয়া পাখি কত বছর বয়সে ডিম দেয়
সাধারণভাবে যেকোনো পাখির ডিম পাড়ার ন্যূনতম বয়স হয় ৫ মাস। টিয়া পাখির ক্ষেত্রেও সেটার ব্যতিক্রম নয়। সকল প্রজাতির টিয়া পাখি ৮ থেকে ৯ মাস বয়সেই ডিম দেওয়া শুরু করে।
টিয়া পাখির প্রজনন কাল
টিয়া পাখির প্রজননকাল সাধারণভাবে সকল প্রজাতির ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস ধরা হয়। তবে প্রজাতি ভেদে প্রজনন কালের কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।
বাসন্তী লটকন টিয়ার প্রজনন কালঃ বিভিন্ন স্থানের আবহাওয়া অনুযায়ী এদের প্রজনন কালে সামান্য তারতম্য দেখা দিলেও প্রধান প্রজনন কাল হিসেবে ধরা হয় জানুয়ারি-জুন। এরা সাধারণত খড়কুটো দিয়ে বাসা না বানিয়ে গাছের কোটরে থাকে এবং সেখানে এই মৌসুমে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পেড়ে প্রজনন প্রক্রিয়া শুরু করে।
সবুজ টিয়ার প্রজনন কালঃ এশিয়া মহাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে এরা তুলনামূলক আগেই সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বাসা তৈরীর কাজ শুরু করে এবং প্রজনন সম্পন্ন করতে করতে জানুয়ারি মাস চলে আসে।
ফুলমাথা টিয়ার প্রজনন কালঃ নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ প্রেমী এই পাখির আদর্শ প্রজনন কাল জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়কে ধরা হয়।
লাল মাথা টিয়ার প্রজনন কালঃ বিভিন্ন নরম গাছের কোটোরে বাসা বাঁধা এই প্রজাতির পাখির প্রধান প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে মে মাস। এরা সবচেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ডিম দেওয়া ও বাচ্চা ফোটানোর কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
চন্দনা টিয়ার প্রজনন কালঃ প্রধান শীত ও গরমের শুরু পর্যন্ত সময় এদের প্রজনন কাল অর্থাৎ নভেম্বর থেকে এপ্রিল।
মদন টিয়ার প্রজনন কালঃ চন্দনা টিয়া এবং মদন টিয়ার প্রজনন কাল একই সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল।
টিয়া পাখির খাবার ও বাসস্থান
টিয়া পাখির স্বভাব
টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতি ভেদে এদের স্বভাবে বিচিত্রতা দেখা যায়। প্রতিটি প্রজাতির টিয়া পাখির উল্লেখিত কিছু স্বভাব আলোচনা করা যাক।
বাসন্তী লটকন টিয়ার স্বভাবঃ পাতা ঝরা আর্দ্র এলাকা ও পাতাযুক্ত চিরসবুজ এলাকার এই টিয়া পাখিটি পারিবারিক পাখি বলেও পরিচিত কারণ এরা সব সময় একটি দলে বিচরণ করে থাকে। ৪০-৫০ টি টিয়া একত্রিত হয়ে একটি দল গঠন করে। এদের খাবার খাওয়ার সময় হলে এরা গাছের ডালে বাদুড়ের মত উল্টো হয়ে ঝুলে খাবার খায় এবং বিশ্রাম করে।
সবুজ টিয়ার স্বভাবঃ এদের সবচেয়ে সুন্দরতম স্বভাব হলো এরা মানুষের কথা হুবহু নকল করতে পারে। এই প্রজাতির টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য হলো এরা কোন সময় জোড়া ছাড়া থাকে না। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিচরণ করলেও রাতের বেলা সবাই একত্রিত হয়। এদের কণ্ঠস্বর অনেক কমল এবং সুন্দর প্রকৃতির হয়।
চন্দনা টিয়ার স্বভাবঃ এই জাতীয় টিয়ার স্বভাব হলো বীজ ধর্মী ফসলের আশেপাশে বসবাস করা এবং এগুলো খাওয়ার চেষ্টা করা। এরা বাধ্যতামূলক ভাবে জোড়ায় জোড়ায় চলে না, তবে মাঝে মাঝে জোড়াতে দেখা যায়। দেখতে সুন্দর কিন্তু কন্ঠ কিছুটা কর্কশ, যদিও তা শুনতে খারাপ লাগে না।
লালমাথা টিয়ার স্বভাবঃ বাসন্তী লটকন টিয়ার মত এরাও দলবদ্ধ ভাবে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। প্রজনন মৌসুম আসলেই স্ত্রী টিয়া হঠাৎ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। খেলাধুলা প্রেমী এই প্রজাতির পাখিরা সহজেই পোষ মেনে যায়। বন্দি থাকা অবস্থায় যা কিছু পেলে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং খেলতে শুরু করে। গোলাকার বস্তুর প্রতি এদের একটা দুর্বলতা রয়েছে। এমন কোন বস্তু দেখলেই ঠোঁট দিয়ে ধাক্কা দিতে থাকে। অনেকেই এই প্রজাতির টিয়া পাখিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে থাকে।
ফুলমাথা টিয়ার স্বভাবঃ অনাবাসিক প্রকৃতির এই পাখিদের স্বভাব অত্যন্ত সুন্দর। এরা পুরুষ এবং স্ত্রী নিজেদের কাজ ভাগ করে নেয়। সাধারণত স্ত্রী পাখির টি বাসা বানানোর দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এছাড়াও তাকে যেহেতু ডিম প্রসব করতে হয়, সেগুলোতে তার দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর দায়িত্বও তার থাকে। অপরদিকে পুরুষ পাখিটি থাকে সুরক্ষার দায়িত্বে। যখন স্ত্রী পাখিটি ডিমে তা দেওয়ার কাজ করতে থাকে তখন পুরুষ পাখি খাবার ব্যবস্থা করে নিয়ে এসে খাইয়ে দেয়।
মদনা টিয়ার স্বভাবঃ চিরসবুজ ও পাহাড়ের আশেপাশে বসবাসরত এই প্রজাতির পাখি তুলনামূলক আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। ১৫-২০ টি করে পাখি দল গঠন করে ঝাঁকেঝাকে উঠতে থাক। উড়তে থাকা অবস্থায় প্রবলভাবে চিৎকার করতে থাকে।শস্যদানা পছন্দ হওয়ায় ঝাকে ঝাকে জমিতে আক্রমণ করতে দেখা যায় এদের। আবার প্রজননের সময় নিজেরা বাসা তৈরি না করে গাছের কোটরে থাকা মাছরাঙ্গা বা কাঠঠোকরার বাসা দখল করে। দলগত কাজ এদের অন্য প্রজাতির টিয়া পাখির তুলনায় শক্তিশালী করে।
লেখকের মন্তব্য
সকল প্রজাতির টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য যেমনি হোক না কেন তারা অতি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যেসব প্রজাতি পোষ মানার নয়
তাদেরকেও আমরা জোর করে খাঁচায় বন্দি করে রাখি। এর ফলে বর্তমানে শখের এই পাখিটির অনেক প্রজাতি বিলুপ্তি করতে শুরু করেছে। টিয়া পাখির বৈশিষ্ট্য ও ধরন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আমরা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ধরে এদের জীবন নষ্ট করছি অজান্তেই। সর্বশেষ কথা এটাই যে আপনি যদি পাখি প্রেমী হয়ে থাকেন, পাখি সম্পর্কে প্রথমে বিস্তারিত জানুন তারপর যেগুলো পোষ মানার নয় তাদের খোলা প্রকৃতিতে মুক্ত জীবন যাপনের সুযোগ করে দিন। পাখি সম্পর্কে আরো কিছু জানার থাকলে কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানাতে পারেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url